Enter your keyword

বিশ্বের প্রতি প্রন্তরে বাংলার মুখ

Sunday, January 29, 2017

এরশাদ শিকদারের শেষ অধ্যায়

By On 9:14:00 PM
এরশাদ শিকদার। ছবি: ডেইলি স্টার।

সারা দেশে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার হিসেবে এরশাদ শিকদারের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল তার উত্থানের পর পরই। সেই প্রতিপত্তির নমুনা হিসেবে তার আস্তানা তৈরি হয় বিশাল এক বাড়িতে, নাম ‘স্বর্ণকমল’। খুলনার সে সময়ের সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়ি ছিল স্বর্ণকমল। ভারত থেকে নকশা করে আনা হয়েছিল এই বাড়ির। দেশ বিদেশের দামী দামী সব আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো এই বাড়ির ভেতরেই লুকিয়ে থাকার জন্য ছিল বাংকার। এরশাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ৭০টি অস্ত্র থাকার তথ্য পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে পুলিশ সেই বাংকার থেকে উদ্ধার করেছিল কেবল একটা বিদেশী বন্দুক ও আর একটা পিস্তল।

স্বর্ণকমল। ছবি: বিগম্যানসবিডি.ব্লগস্পট.কম।

যার জীবনের সমস্ত সম্পদ রক্ত দিয়ে তৈরি, যার উত্থানের প্রতিটি ধাপ মানুষের রক্ত দিয়ে গড়া, তার আবাসস্থল বাড়িটার ইতিহাসে রক্ত মেশা থাকবে না, তা তো হয় না। বাড়িটা নির্মাণের সময়ে দায়িত্বে থাকা লোকটি নির্ধারিত জমির চেয়ে মাত্র এক ইঞ্চি এদিক ওদিক করে ফেলেছিল, এই ছিল তার অপরাধ। সেই অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে নারকীয় কায়দায় খুন করে এরশাদ শিকদার।
ধর্ষণের শিকার নারীদের নিয়ে আসা হত এই ঘরে। ছবি: (২০১০) ‘সবাক’, সুমন সওদাগরের ব্লগ


এরশাদ শিকদারের অপরাধ জীবনের সবচেয়ে আলোচিত খুনের ঘটনা ছিল যুবলীগ নেতা খালিদ হত্যা। এই হত্যার ঘটনায় করা মামলাতেই গ্রেফতার করা হয়েছিল এই নরপিশাচকে।

১৯৯৯ সালের ১৬ মে, রাত সাড়ে ৮ টা। এরশাদের টেলিফোন এসেছে- কথা আছে, যেতেই হবে। এরশাদ শিকদারের ডাক কি অমান্য করা যায়! তার মানুষ খুনের আস্তানা সেই বরফকলের দিকে রওনা হল খুলনা জেলা ছাত্রলীগ নেতা অসিত বরণ বিশ্বাস, আবু হানিফ, আলী আকবর। সাথে ব্যবসায়ী সৈয়দ মনির মীর ও তার ছোট ভাই চয়ন মীর আর যুবলীগ নেতা খালিদ হোসেন। খুলনার জলিল শপিং কমপ্লেক্সের মালিক সৈয়দ মনিরের নতুন কেনা গাড়ি আর দুটো মোটর সাইকেলে চড়ে বরফকলে পৌঁছাল তারা।

তখনও কেউ টেরও পায়নি কী ঘটতে যাচ্ছে একটু পর। এরশাদ শিকদার তাদের আপ্যায়ন করল ঠাণ্ডা স্লাইস দিয়ে। চারিদিকে শীতল পরিবেশ। হঠাৎ সবার বুক কেঁপে উঠল এরশাদের কণ্ঠস্বর শুনে। সৈয়দ মনিরকে ডেকে সে বলে উঠল, “খুলনার এক সময়ের বিগ ফ্যাক্টর কাশেম সাহেবকে গুলি করে মারার সময় কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি, মনির তোকে গুলি করলেও কেউ আসবে না।” এই বলে সে হাসতে হাসতে ডাক দিল সহযোগী মুন্সী আইয়ুবকে, “মুন্সী আইয়ুব! রাইফেল লে আউ!”।

এরশাদের সে হাসিতে কারো কারো প্রাণ চলে এল গলার কাছাকাছি। চকচকে রাইফেল নিয়ে মুন্সী আইয়ুব এল, সাথে এল লিয়াকত, জামাই ফারুক আর এরশাদের বডিগার্ড নুরে আলম। তখন এরশাদ শিকদারের মাথায় খুনের নেশা। আর এ নেশার ঘোরেও নাটকীয়তা। রাইফেল হাতে নিয়ে মনিরের কানের ঠিক পাশ দিয়ে তিনটি গুলি করল প্রথমে। ভয়ে মনির জড়িয়ে ধরল আবু হানিফকে। চিৎকার করে উঠল সে, “কী হচ্ছে?”। উত্তরে তাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেটানো শুরু করল এরশাদ।

রক্তের নেশাগ্রস্ত নরপিশাচের মরণকামড় থেকে প্রাণ বাঁচাতে চয়ন, অসিত, হানিফ আর খালিদ দৌড়ে গিয়ে ঢুকল গাড়িতে, পেছনে পেছনে দৌড়ে গেল এরশাদ। বন্দুকের বাঁট দিয়ে গাড়ির কাচ ভেঙ্গে ফেলল সে। টেনে বের করে আনল খালিদকে। মাটিতে ফেলে পেটানো শুরু করল তাকে, এদিকে হানিফ, চয়ন আর আকবর আলী দৌড়ে পালালো সেখান থেকে। বরফকলের অদূরে দাঁড়ানো ছিল তিন কোস্ট গার্ড সদস্য। খালিদ তাদেরকে ডাকল চিৎকার করে, কিন্তু এগিয়ে এলো না কেউ। মনিরকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে ইচ্ছেমত পেটালো এরশাদ। এরপর বরফকলের বরফ ভাঙার ২০ কেজি ওজনের মুগুর নিয়ে আসা হল। সেটা দিয়ে থেঁতলে দেয়া হল তার পা। এরপর এরশাদ লাফিয়ে উঠল তার বুকের ওপর, জ্ঞান হারালো মনির। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে! এত কিছুর পরেও ভাগ্যের জোরে সৈয়দ মনির সেদিন মরেনি। কিন্তু পৈশাচিক নির্যাতনে মারা গেল যুবলীগ নেতা খালিদ। মুগুরের পিটুনি, বুকের ওপর উঠে এরশাদের অগণিত লাফ আর শ্বাসরোধ এ তিন কায়দার নির্যাতনে মারা হল খালিদকে। ভৈরব নদীতে সিমেন্টের বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হল খালিদের লাশ, গাড়ি আর মোটর সাইকেল দুটোও। আর এটাই ছিল এরশাদ শিকদারের হাতে খুন হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে একমাত্র লাশ যেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল পরবর্তীতে।

১৯৯৯ সালের ১১ আগস্ট। মিসরে ফেরাউনের ক্ষমতার মতই খুলনায় দোর্দণ্ড প্রতাপ এরশাদ শিকদারের। তিন মাস আগে করা খালিদ খুনের কারণে তার নামে মামলা হয়েছে। খালিদের লাশও পাওয়া গেছে। এই সময় এরশাদ শিকদার হয়ত ভেবেছিল তার ক্ষমতার জোরটা দেখিয়ে একটা নাটক করে নেয়া যাক। এতদিন পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা না পড়ার জন্য অভিনব এক কাজ করত এরশাদ। এলাকার কবরস্থানে দুটি নকল কবর বানিয়ে রেখেছিল সে। পুলিশ এলেই সেখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকত। এবারে নাটকের শখ হওয়ায় সে সিদ্ধান্ত নিল নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেবে। প্ল্যান হল। প্ল্যান মত একদিন সকালে রেলওয়ের রেস্ট হাউজে সে দলের ক্যাডার আর ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করল। সকাল দশটার দিকে রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিল, দোয়াও চাইল। পুলিশ এল সে সময়। পুলিশের আগমনে একটা সাজানো হইচই তৈরি করা হল। হইচইয়ের মাঝখানে এরশাদ নিজেই উঠে পড়ল পুলিশ ভ্যানে।
কবরস্থানের খেলনা কবর, এখন সেখানে খেজুর গাছ। ছবি: (২০১০) ‘সবাক’, সুমন সওদাগরের ব্লগ

কিন্তু তার জানা ছিল না, ইতিহাসে ন্যায় অন্যায়ের লড়াইয়ে কখনোই অন্যায় শেষ জেতা জিততে পারেনি। যতই পরিকল্পনা থাকুক না কেন, এরশাদ শিকদারের সেই ব্লু ম্যাপ মাঠে মারা পড়ল। তৎকালীন খুলনা মহানগর পুলিশ কমিশনার আনোয়ারুল ইকবাল অনড় ভূমিকা নিলেন। এরশাদের নামে মামলা হল যাবতীয় কর্মকাণ্ডের দায়ে।

সেবার ধরা পড়ার পর আর তার ফিরে যাওয়া হল না মানুষ খুনের কারখানা ওই বরফকলে। ২০০০ সালের ৩০ এপ্রিল খুলনার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারক এম হাসান ইমাম এরশাদ শিকদারের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন। এছাড়া ১৭টি খুনের মামলার ৬ টিতে ফাঁসি ও ৫টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হল।

শোনা যায়, বাংলা সিনেমা জগতের খ্যাতিমান এক ভিলেনকে এরশাদ শিকদার আড়াই কোটি টাকা দিয়েছিল, শর্ত ছিল ঐ ছবিতে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করবে সে। তার আর চলচ্চিত্রের ভিলেন হওয়া হয়ে উঠল না। টাকা দেয়ার চার-পাঁচ মাস পরেই সেই যে একবার ঢুকল এরশাদ চৌদ্দ শিকের ভেতরে, ওখানেই মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গেল বাস্তব দুনিয়ার ভয়ঙ্কর এই ভিলেনের।
ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হত এই ঘরে। ছবি: (২০১০) ‘সবাক’, সুমন সওদাগরের ব্লগ

এরশাদের বডিগার্ড নুরে আলমই তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় রাজসাক্ষী হয়ে। এই নুরে আলমের জীবনেও ছিল এরশাদের নির্মমতার অভিজ্ঞতা। একবার গাড়িতে করে বাসায় ফেরার সময় রাস্তায় এক মেয়ের ওপর নজর পড়ে এরশাদের। নুরে আলমকে দিয়ে মেয়েটাকে সে নিয়ে আসে আস্তানায়। বিকৃত এক পরিকল্পনা করে এরশাদ। নুরে আলমকে সে আদেশ দেয়, মেয়েটাকে তক্ষুণি বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করতে রাজি হয় সে, এরশাদ তাকে পাঠায় বিয়ের কাপড় আনতে। সে যাওয়ার পরেই এরশাদ চড়াও হয় মেয়েটার ওপর। নুরে আলম কিছুই জানতে পারেনি। এরপর মেয়েটার সাথে বিয়েও তার। কিন্তু বিয়ের পরও এরশাদ থামল না। নুরে আলমের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর উপর নির্যাতন চলতে লাগল। একদিন সে দেখে ফেলল এই ঘটনা। তখন এরশাদ তাকে বলল, “জীবন তো ভোগের জন্যই, সব কিছু ঠাণ্ডা মাথায় নাও।” নুরে আলম হয়ত তখন ঠাণ্ডা মাথায় হজম করেছিল বসের এই অপমান। কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে, শেষ পর্যন্ত সেই সুযোগ আসে। রাজসাক্ষী হয়েই সে এর প্রতিশোধ নেয়। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত এরশাদের ২৪টি খুনের প্রত্যক্ষদর্শী ও সহযোগী ছিল নুরে আলম। সবগুলো খুনের ঘটনায় এরশাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় সে।

ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে এরশাদ। আপিল বিভাগের রায়ে তার ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়। মহা ক্ষমতাধর এরশাদ শিকদার ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির ক্ষমা জোটেনি তার কপালে। এ খবর শুনে ব্রাশের খাপ পেটে ঢুকিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে এরশাদ। কিন্তু ইতিহাসের নিষ্ঠুর এ খুনীর মৃত্যু এত সহজে হোক সেটা হয়ত চায়নি প্রকৃতি। আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

কারাগারে এরশাদ দিন কাটাত ভাবলেশহীনভাবে। ভয়াবহ অপরাধ জীবনের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছিল না তার। ‘আমি তো মরে যাব চলে যাব রেখে যাব সবই’ কিংবা ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গান গেয়ে সময় কাটাত সে। ছিঁচকে চোর থেকে রক্তখেকো খুনী হয়ে বিশাল সম্পত্তি বানিয়েছিল এরশাদ শিকদার। তার বিশ্বাস ছিল এই অঢেল সম্পদের জোরে সে বেঁচে যাবে হয়ত। কিন্তু প্রকৃতির বিচার বলেও একটা কথা আছে। চরম দৈন্যদশায় জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো কাটাতে হয় এই গডফাদারকে কারাগারের কনডেম সেলে বন্দী হয়ে।

১৯৯২ সালের ২৬ আগস্ট রাতে আবুল ওরফে সিদ্দিককে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল খুলনা জেলা কারাগারে। এর ১ যুগ পর সেই ফাঁসির মঞ্চ আবার প্রস্তুত করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের বর্বরতম এই খুনীর জন্য। আর ফাঁসি দিতে প্রস্তুত হয় তিন জল্লাদ- শাহজাহান ভুঁইয়া, হাফিজ উদ্দিন ও হারেস মিয়া।

মৃত্যুর মাত্র বারো ঘণ্টা আগেও এরশাদ মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যায়নি। বেলা ১২টার দিকে খাসি আর মুরগীর মাংস দিয়ে ভাত খায় সে। এরপর ঘুম। ঘুমানোর পর আত্মীয়দের সাথে দেখা হয় তার। এরপর আবারো ঘুম। মরণঘুমের আগের বারো ঘণ্টার প্রায় ছয় ঘণ্টা ঘুমিয়েই কাটায় এরশাদ। সন্ধ্যায় ওঠার পর ইলিশ আর রুই মাছ দিয়ে ভাত খায় সে। এই ছিল শেষ খাওয়া। রক্ত যার জীবন নেশা, মৃত্যুর আগে এই মাছভাত খাওয়ায় সে তৃপ্তি পেয়েছিল কিনা কে জানে।

রাত দশটায় তাকে জানানো হয় ফাঁসি হবার কথা। জীবনের শেষ মুহূর্ত চলে এল, কিছুক্ষণ পরের নিঃশ্বাসটাই হবে তার শেষ নিঃশ্বাস। এই মুহূর্তে এসে পরাক্রমশালী খুনী এরশাদের বুকেও হয়ত ভর করেছিল মৃত্যুর ভয়। হাসতে হাসতে কত নিরপরাধ মানুষের বুকের উপর নাচতে নাচতে তাদের পাঁজর ভেঙেছে, কত নিরপরাধ মানুষের লাশ মাগুর মাছকে খাইয়েছে সে কথা হয়ত মনে পড়ছিল তার। নিজের জীবনলীলা সাঙ্গ হবার আগে সেই সব ভয়ঙ্কর স্মৃতি মনে পড়াতেই হয়ত মরণ ওপারের শাস্তি থেকে বাঁচার আশা নিয়ে তখন কলেমাও পড়েছিল এরশাদ। দুই জল্লাদ শাহজাহান ও হারেস তার দুই হাত দুই দিক থেকে ধরে ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে আসল। একটা কালো লম্বা টুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে ওঠানো হল তাকে।এরপর তার গলায় পরানো হল ম্যানিলা রোপ নামের ফাঁসির দড়ি। ২০০৪ সালের ১০ মে রাত ১২টা ১ মিনিটে রুমাল ফেলা হল, জারি হয়ে গেল খুনী এরশাদের মৃত্যু পরোয়ানা। রুমাল মাটিতে পড়ার সাথে সাথে পায়ের নিচের পাটাতন সরিয়ে দেয়া হল তার। ফাঁসি হল এরশাদের। আধা ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখার পর লাশ নামিয়ে এনে পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করল ডাক্তার। মৃত্যু আরো নিশ্চিত করতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে দেয়া হল তার হাত ও পায়ের রগ। অবসান হল পৃথিবীর বুকে মানুষের রক্ত নিয়ে উন্মাদ খেলায় মেতে থাকা এক দানবের জীবন।

এরশাদ শিকদারের মৃত্যুর পর তার নির্যাতনের শিকার এক নারীর কাছ থেকে সাংবাদিকরা জানতে পারে এই নরপিশাচের ঘৃণ্য এক লালসার কথা। সেই নারীটি ঘাট এলাকায় এসেছিল তার স্বামীর সাথে। সেখানে স্বামীটি এরশাদের অপরাধ জগতের কাজে জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে এরশাদের নজর পড়ে ঐ নারীর উপর। কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে পরিকল্পনা মাফিক তার স্বামীর বিরুদ্ধে তিন লাখ টাকা চুরির অভিযোগ দেয়া হয়। বলা হয় তিন দিনের মধ্যে ফেরত না দিলে তাকে মেরে ফেলা হবে। জীবন বাঁচাতে কাকুতি মিনতি করলে এরশাদ বলল তার কথা মত চললেই কেবল বাঁচা যাবে। এরশাদের কথা মত নিয়মিত তার ভোগের শিকার হতে হয় নারীটিকে। এর মধ্যে দুটো মেয়ের জন্ম দে সে নারী। সেই মেয়ে দুটোর ভরনপোষণের টাকাও দিত এরশাদ। এরপর ওরা যখন বড় হল, পৃথিবীর বুকে ঘটল অত্যন্ত নির্মম আর ঘৃণ্য এক ঘটনা। এরশাদ শিকদারের লালসার শিকার হল এই মেয়ে দুটিও!

এই রক্তলোভী দানব হয়ত ভেবেছিল তার ক্ষমতা আকাশচুম্বী, কিন্তু এই পৃথিবীটা তো মানুষেরই, দানবের নয়। যে ষাট জন মানুষের এরশাদ শিকদারের হাতে খুন হওয়ার কথা জানা যায়, তাদের রক্তসুধা পানের সময়, শ্বাসরোধ করে তাদের হাত পায়ের ছটফটানি দেখে আনন্দ নেবার সময়, তাদের বুকের উপর বুট জুতো পরে লাফিয়ে পাঁজর ভেঙে দেয়ার সময়; এরশাদ শিকদার কি একবারও ভেবেছিল, একদিন হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় শুধু পায়ের নিচ থেকে একটা পাটাতন সরে গিয়ে তারও মৃত্যু হবে?



মনে আছে এরশাদ শিকদারের কথা?

By On 9:04:00 PM
ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা। তার মাঝে ছোট্ট একটা গ্রাম মাদারঘোনা। এই গ্রামেই জন্ম নিয়েছিল এমন একজন যে কিনা পরিণত বয়সে ধারণ করেছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের বর্বরতম খুনীর তকমা। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত মানুষের পাঁজরের উপরে উন্মাদ নৃত্য করা ছিল যার প্রিয় শখ। রক্তের ফিনকিতে জিঘাংসা মিটিয়ে একেকটা খুনের পর দুধ দিয়ে গোসল করা ছিল যার রেওয়াজ। নাম তার এরশাদ। এরশাদ শিকদার।
এরশাদ শিকদার। ছবি: ডেইলি স্টার।

মাদারঘোনা গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক বন্দে আলী মিঞার ছোট ছেলে এই এরশাদ। তার ছেলেবেলাটা জীবন বাস্তবতার বেশ কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই কেটেছিল বলা যায়। নিজের জমি ছিল না বন্দে আলীর, ছোটখাটো ব্যবসা আর খুচরো কাজ করে সংসার চলত কোনো রকম। এরশাদের বয়স যখন বারো কি তেরো, তখন কঠিন এক অসুখে পড়ে মারা যায় বন্দে আলী।

অভাবের সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করল মা, বাড়ি বাড়ি কাজ করতে লাগল। এদিকে এরশাদ ব্যস্ত এলাকায় ডানপিটেমো করতে। স্কুল পালানো তো বটেই, এর ওর সাথে মারপিট, এটা সেটা চুরি- এই করেই তার সময় কাটছে তখন আর প্রতিদিন মায়ের কাছে তার নামে নালিশ আসছে। এর মাঝেই একদিন এরশাদ এক ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হল।

এরশাদদের বাসায় প্রায়ই এক লোক বেড়াতে আসত, তাদের প্রতিবেশী। এলাকায় বেশ ক্ষমতাবান সে। একদিন এরশাদ জেনে গেল কেন ঐ লোকটা আসত তাদের ঘরে। তার মায়ের উপর অন্যায় লালসা মেটানোর দৃশ্য দেখে ফেলল সে। ঐ মুহূর্তে তার মাথার কোষগুলোতে কী চলছিল আমরা জানি না। তবে এটা জানি, এমন একটা সময় এরপর এসেছিল, যখন এই এরশাদের ভয়ঙ্কর নিপীড়নমূলক লালসার শিকার হতে হয়েছে অসংখ্য নারীকে। এমনকি তার ভোগের তালিকা থেকে বাদ পড়েনি নিজের ঔরসজাত কন্যাও। সে গল্পে পরে আসছি…

১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে এরশাদরা খুলনার ঘাট এলাকায় চলে এল, সে-মা-আর বড় ভাই। মা এলাকার বাসায় বাসায় কাজ করতে লাগল, বড় ভাই হল ঘাটের কুলি, আর এরশাদ হল ঘাটের কুলিদের নেতা কাশেম সরদারের সহযোগী। এবারে সে পুরোদমে শুরু করল ছিঁচকে চুরি। প্রায়ই সে ধরা পড়ত চুরি করতে গিয়ে। গায়ের রং ফরসা হওয়ায় অনেকেই তাকে ডাকত রাঙ্গাচোরা, কেউ কেউ ডাকত ধলাচোরা বলেও।

ট্রলার থেকে মাছ আর গম চুরি, জাহাজ থেকে তেল চুরি এসব করেই অপরাধের অন্ধকার জীবনে হাত পাকাতে লাগল এরশাদ। এর মধ্যে কাশেম সরদারের জায়গায় এল আঞ্জু সরদার। দ্রুতই আঞ্জু সরদারের কাছের লোক হয়ে উঠল সে। হঠাৎ একদিন ভয়াবহ এক ঘটনা ঘটল। আঞ্জু শিকদারের সমকামিতার শিকার হল এরশাদ।

১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে এরশাদের নতুন সঙ্গী হল একটা রামদা। এই রামদা নিয়ে ঘাট এলাকায় সে শুরু করল ডাকাতি আর ছিনতাই। বেশ কিছু সঙ্গীও জুটল এ সময়। এরশাদের কাজের মাত্রা হয়ে উঠল আরও ভয়ানক। পাঁচ জন চেলা-চামুণ্ডা সাথে নিয়ে সে একটা দল তৈরি করল। এই দলের সদস্যদের কাজ ছিল বার্জ-কার্গো থেকে পণ্য চুরি করে নদীতে লাফিয়ে পড়া। সময়ের সাথে সাথে গ্রুপের সদস্য বাড়তে লাগল, বাড়তে থাকল অপরাধের মাত্রাও। রেললাইনের স্লিপার চুরি, কাঠ চুরি, রেলের ওয়াগন ভাঙা এসব চলতে লাগল পুরোদমে। ট্রলারে চাঁদাবাজিও শুরু হল। গমের বস্তা পাচার আর সিমেন্টের বস্তা খুলে বালি মেশানোও চলতে লাগল। আর ঘাট এলাকায় চাঁদাবাজি তো ছিলই।

১৯৮২ সাল। সামরিক স্বৈরাচারি সরকার এল ক্ষমতায়। তখন খুলনার সিটি মেয়র হল কাজী আমিন। আর তখনকার উঠতি গুণ্ডা সর্দার এরশাদ হয়ে উঠল কাজী আমিনের কাছের লোক। তার চাঁদাবাজি-মাস্তানি করার শক্তি বেড়ে গেল অনেক গুণ। এক সময় যার সহযোগী ছিল এরশাদ, সেই কাশেম সরদারকে হটিয়ে দিল সে। ক্ষমতার পরিধি আরও বড় হল। খুলনার চার-পাঁচ নাম্বার ঘাট এলাকা, রেলওয়ে কলোনি আর আশেপাশের মার্কেটগুলোতে একক অধিপতি হয়ে উঠল সে।

এরপর শুরু হল দখলের পালা। ১৯৮৪ থেকে ’৮৬ এই সময়টা জুড়ে এরশাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হল দখলের মধ্য দিয়ে। রেলওয়ের মার্কেট করায়ত্ত করল সে। রেলওয়ের জায়গা দখল করে নতুন মার্কেটও তৈরি করল। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ঙ্করতম এক ব্যবসা মাদক, এরশাদের নজর পড়ল সেখানেও। খুলনায় মদ-গাঁজা-হেরোইন-ফেনসিডিলের ব্যবসায় হাত পড়ল তার।

১৯৮৮ সাল। এরশাদ শিকদারের অপরাধ জগতে যুক্ত হল প্রশাসনিক ক্ষমতা। সেবারে ভোটারবিহীন নির্বাচনে খুলনার তৎকালীন ২১ নাম্বার, বর্তমানে ৮ নাম্বার ওয়ার্ডের কমিশনার হল এরশাদ। আরও ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল তার সাম্রাজ্য। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, বাংলাদেশ বিমান আর বাংলাদেশ রেলওয়ের জায়গা দখল করে গড়ে তুলল বস্তি। বস্তি জুড়ে ছোট ছোট ঘর। কুলি-রিকশাওয়ালা-দোকানী-হোটেল কর্মচারী-ওয়ার্কশপ মেকানিক এমন নানান পেশার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ বস্তিতে থাকা শুরু করল এক সময়। এদের মধ্যে অনেকেই যুক্ত হয়ে পড়ল এরশাদ শিকদারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে।

এরশাদ শিকদার। ছবি: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এভাবে এরশাদ হয়ে উঠতে লাগল দক্ষিণাঞ্চলের অপরাধ জগতের একচ্ছত্র অধিপতি। একই সাথে পরিণত হতে লাগল রক্তপিপাসু এক ভয়ংকর দানবে। মানুষের রক্ত নিয়ে পাষাণ ক্রীড়ায় মত্ত হয়ে ওঠার দিনগুলো শুরু হল তার। সে সময় তার অবৈধ ব্যবসার বিরোধিতা করার চেষ্টা করত কেউ কেউ। কিন্তু বিরোধীতা সহ্য করার লোক তো সে নয়। এর জন্য শাস্তি নির্ধারিত হত একটাই, এরশাদের হাতে পৈশাচিক কায়দায় খুন হয়ে যাওয়া। এ নিয়ে বলতে গেলে ইনসাফ, কামাল ও খালেক নামের তিন নৈশপ্রহরীর কথা আসবে শুরুতেই। একবার তারা এরশাদের চোরাচালানের কিছু মালামাল ধরিয়ে দিয়েছিল পুলিশের হাতে। এত বড় আস্পর্ধা! ভয়ানক ক্ষিপ্ত হল এরশাদ। এই তিনজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল এলাকার প্রভাতী স্কুলের পেছনে। এরপর একেকজনকে মাটিতে ফেলে বুকের উপর লাফাতে লাগল এরশাদ। অবিরাম আঘাতে পাঁজর ভেঙে দেয়া হল তাদের। তারপর গলায় নাইলনের দড়ি দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হল একে একে। এদিকে, সেই খুনের দৃশ্য দেখে ফেলে শাহজাহান নামের একজন। এর শাস্তিও ঐ একটাই। তাকেও ঘাট এলাকায় নিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হল।

একবার তার মাদক ব্যবসায় বাধা দিতে চেয়েছিল নান্টু। এই অপরাধে প্রথমে তাকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারপর আবার লোক পাঠানো হয় হাসপাতালে। তারা বিষাক্ত ইনজেকশন শরীরে ঢুকিয়ে খুন করে নান্টুকে। এরশাদের সাথে ব্যবসা করে তা থেকে ছুটে বা ফিরে আসারও কোনো উপায় ছিল না। একবার এরশাদের সহযোগী ছয় ব্যবসায়ী তার সাথে আর ব্যবসা করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এত বড় অপরাধ! শাস্তি দেয়া হল নারকীয় নাটকীয়তায়। একদিন তাদের দাওয়াত দিল এরশাদ। সারা দিন নানান খাবার দিয়ে ভরপেট আপ্যায়ন করা হল তাদেরকে। তারা জানত না সবশেষে কী আতিথেয়তা অপেক্ষা করছে। নিদারুণ নির্মমতায় একে একে ছয়জনকেই নিজস্ব বর্বর কায়দায় খুন করল এরশাদ। ছয়টা লাশ ডুবিয়ে দেয়া হয় ভৈরব নদীতে।

১৯৯১ সাল। সামরিক সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় তখন বিএনপি। এতদিনের ভোল পাল্টে ফেললো এরশাদ। বিএনপিতে যোগ দিল সে। এবারে এরশাদ শিকদারের সম্পত্তির তালিকায় যুক্ত হল একটা বরফকল। এই বরফকলটাই পরবর্তীতে হয়ে উঠে বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়াবহতম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। ঘাট এলাকার একমাত্র এই বরফকলের মালিক ছিল রফিক। তাকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সেটা দখল করে নিয়েছিল এরশাদ। ঘাটের প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে এই কল থেকে বরফ নেয়ার জন্য বাধ্য করা হত। বরফকলটা পরিণত হয়েছিল রক্ত হিম করা পৈশাচিক এক আতঙ্কের নামে। কারণ এরশাদ শিকদার এখানে চালাত রক্ত মাংসে গড়া একেকটা মানুষের শরীর নিয়ে পৈশাচিকতম বর্বরতা। কী বন্ধু, কী শত্রু, এরশাদ শিকদারের রক্তের লোভ ছাড়েনি কাউকেই। একের পর এক মানুষ খুনের কারখানা এই বরফকলে একটা এয়ার কন্ডিশনড রুম ছিল। এই রুমে এরশাদ শিকদার আয়োজন করত মদ-জুয়ার আসরের।
আর সে আসরে নিয়মিত যোগ দিত স্থানীয় প্রশাসন-পুলিশ-রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, শোনা যায় বাংলা চলচ্চিত্রের এক নামকরা ভিলেনও উপস্থিত থাকত সেখানে। মদ জুয়ার আসর শুধু নয়, বিলাসবহুল প্রমোদ বিহারের আয়োজনও করা হত এদেরকে নিয়ে। এভাবে ধীরে ধীরে ক্ষমতাশীল লোকদের নিজের পকেটে পুরতে লাগল এরশাদ শিকদার। নরপিশাচ হয়ে ওঠার রাস্তাটা আরো মসৃণ হতে লাগল।

এরশাদ তখন তৎকালীন ২১ নাম্বার ওয়ার্ডের কমিশনার। তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী পার্শ্ববর্তী ১৫ নাম্বার ওয়ার্ডের কমিশনার আওয়ামী লীগ নেতা মোসলেম উদ্দিন খান। প্রতিপক্ষ গ্রুপ একবার মামলা করল এরশাদ আর তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। কোনো এক কারণে মামলার আসামীর তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় এরশাদের দলের টাক আজিজ নামের একজন। সন্দেহ হল এরশাদের। কেন তার নামে মামলা হল না, সে নিশ্চয়ই অন্য গ্রুপকে সহায়তা করে! এরপর কেবল সন্দেহ মেটানোর জন্যই এরশাদ খুন করল টাক আজিজকে।

তখন চার আর পাঁচ নাম্বার ঘাট ছিল এরশাদের নিয়ন্ত্রণে, ওদিকে সাত নাম্বার ঘাট আর রুজভেল্ট জেটি ছিল মোসলেমের নিয়ন্ত্রণে। এই দুই সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে ঘাট এলাকা জুড়ে চলত কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি, আর সাথে মাদক ব্যবসা। এরশাদের সরাসরি বিরোধীতা করে ঘাট এলাকায় বেঁচে থাকা তখন প্রায় অসম্ভব। মোসলেমও পারল না। ’৯৩ সালের রোজার সময় মোসলেমের উপর গুলি আর বোমা নিয়ে হামলা করল এরশাদের বাহিনী। খুন হল মোসলেম। আর এরপরই পুরো ঘাট এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে গেল এরশাদের হাতে।

এক খুনের সুতোয় আরেক খুনের মালা গাঁথা হতে লাগল তারপর। মোসলেম খুনের দায়ে মামলা হল এরশাদের নামে। সে মামলার বাদীকে ফাঁসাতে আরেক খুনের আশ্রয় নিল এরশাদ। এবারের শিকার জয়নাল। অথচ এই জয়নাল ছিল তারই ঘনিষ্ট সহযোগী। জয়নালকে খুন করার পর সেই খুনের জন্য এবার একটা মামলা করা হল। আর এই মামলার আসামী করা হল মোসলেম হত্যা মামলার বাদী বাবুলকে।

হাসতে হাসতে নির্মম পৈশাচিক অত্যাচার করা হয়ে দাঁড়ালো এরশাদ শিকদারের কাছে ডালভাত ব্যাপার। বরফকল ছাড়াও খুলনা শহরের বিভিন্ন জায়গায় কতগুলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছিল সে। রেলওয়ে এলাকার পুরাতন পানির টাংকি, বরফকলের পেছনে পরিত্যক্ত মঠ এসব জায়গায় ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পগুলোর কোনোটাতে মানুষ মারা হত ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে, কোনটায় গুলি করে।
গুলি করে মারা হত এই ঘরটাতে। ছবি: (২০১০) ‘সবাক’, সুমন সওদাগরের ব্লগ

জেমস বন্ড সিনেমার ব্লোফেল্ডের মানুষখেকো পিরানহা মাছের সেই ভয়ঙ্কর পুলের মত এরশাদ শিকদার তার বস্তির ভেতরে বানিয়েছিল ১০ থেকে ১২ হাত গভীর একটা হাউজ। ওই হাউজে চাষ হত রাক্ষুসে আফ্রিকান মাগুর। পৈশাচিক কায়দায় মানুষ খুনের পর লাশ ফেলে দেয়া হত এই হাউজে। একেকটা রক্ত মাংসের মানুষের শরীর হয়ে উঠত রাক্ষুসে মাগুরের খাবার।
এই হাউজেই আফ্রিকান মাগুরের খাবার হত লাশগুলো, এখন পরিত্যক্ত। ছবি: (২০১০) ‘সবাক’, সুমন সওদাগরের ব্লগ

এরশাদের এইসব আস্তানা আর ক্যাম্প বানানোর জন্য যত জমি দরকার হত তার কেনাবেচার দালালি করত ঢাকাইয়া আজিজ। এই কাজটাই তার জন্য কাল হয়েছিল। তার অপরাধ ছিল, দালালির সুবাদে সে এরশাদের নানান জায়গার সম্পত্তির বিবরণ জানত। এরপর এরশাদের হাতে লাশ হয়ে ভৈরব নদীতে ডুবে সেই অপরাধের শাস্তি পেতে হয় ঢাকাইয়া আজিজকে।

খুলনার বড়বাজার এলাকায় সুদের ব্যবসাও শুরু করেছিল এরশাদ। জামানত ছাড়াই তার কাছ থেকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ নিত। চড়া সুদে এসব ঋণ দিয়ে রীতিমত একটা ব্যাংক ব্যবসা চালু করেছিল সে। ১৯৯৫ সালের দিকে এরশাদের সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেল। সে সময় তার টাকা পয়সার হিসেব রাখত জাহাঙ্গীর। সে আবার এরশাদ শিকদারের ছেলেমেয়েদের পড়াত। এ জন্য তার নাম হয়েছিল মাস্টার জাহাঙ্গীর। গল্প আছে, সে নাকি এরশাদ শিকদারের স্ত্রী খোদেজার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিল। এদিকে এরশাদের ১০০ কোটি টাকার সম্পদের কথাও সে তার এক বন্ধুকে বলে ফেলেছিল। এ সব কিছুই জানতে পারে এরশাদ। ফলাফল- তাকে নিয়ে আসা হল বরফকলে। বরফ ভাঙার মুগুর দিয়ে ভাঙা হল তার হাত-পা। এরপর বুকের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে ভাঙা হল তার পাঁজর। সবশেষে শ্বাসরোধ করে খুন করা হল মাস্টার জাহাঙ্গীরকে।
এরশাদের বিচারের পর ফাঁসি দেয়ার ঘরে নিয়ে যাওয়া হত এই দরজা দিয়ে। ছবি: (২০১০) ‘সবাক’, সুমন সওদাগরের ব্লগ

১৯৯৬ সালে আবার ক্ষমতায় এল আওয়ামি লীগ। আবারও ভোল পাল্টানোর সময় হল এরশাদের। ১৯৯৭ সালে, যখন আওয়ামী লীগ নেতা মোসলেম উদ্দিন খান হত্যার প্রধান আসামী এরশাদ, যখন পুলিশের রেকর্ডে তার নামে ত্রিশটি মামলা রয়েছে, যখন তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ পুরস্কার ঘোষণা করেছে, সে অবস্থাতেই, খুলনা সার্কিট হাউসে পুলিশের সামনে আওয়ামী লীগ নেতাদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে দলে যোগ দিল এরশাদ। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বিতর্ক শুরু হওয়ায় ‘৯৮ সালে তাকে বহিস্কার করা হল আওয়ামী লীগ থেকে।

এরশাদের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে কিংবা কেবল সন্দেহের অবসান ঘটাতেই মাস্টার জাহাঙ্গীর ছাড়াও খুন হতে হয়েছে আরো অনেককে। এমনই এক শিকার এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির ফটিক। ফটিক জানত না কত অবলীলায় মৃত্যুর সাথে সখ্যতা করেছিল সে। এরশাদের পরিবারের সাথে খাতির ছিল তার। নিয়মিত আড্ডা দিতে যেত তাদের বাড়িতে। এর মাঝেই খোদেজার সাথে হয়ত কোনো সম্পর্ক হয়েছে ফটিকের, এমন সন্দেহ হয় এরশাদের। এরশাদ শিকদারের সন্দেহ! শাস্তি সেই একটাই। সেই সন্দেহ দূর করতে পৈশাচিকভাবে খুন হয়ে যেতে হয় এডভোকেট ফটিককে।

আকিমুলের খুনের ঘটনাটিকে হয়ত প্রকৃতির নির্মম রসিকতাও বলা যায়। ঝিনাইদহের টেলিফোন অপারেটর ছিল আকিমুল। এক রাতে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে দৈবক্রমে সে ফোন করে ফেলে এরশাদের বাসায়। বুঝতে পারে নি সে, নিজের অজান্তে মৃত্যুদূতকেই ফোন দিয়েছিল। এরপর এরশাদের স্ত্রী খোদেজার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ল আকিমুল। এমনকি তাকে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনাও করেছিল। জেনে ফেলে এরশাদ। বেজে গেল মরণঘণ্টা। পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে দুজনই। খোদেজাকে বাড়ি পাঠিয়ে আকিমুলকে নিয়ে আসা হল বরফকলে। সে দিনই জমাট সিমেন্টের বস্তার সাথে বাঁধা অবস্থায় আকিমুলের স্থান হল ভৈরব নদীর তলায়।




Thursday, January 26, 2017

সাধারণ মানুষ যেতে পারেন না পৃথিবীর এই সমস্ত জায়গায়

By On 9:14:00 PM

বরফ ঢাকা পাহাড়ের শৃঙ্গ থেকে সবুজ-নীল গভীর সমুদ্রে তিমি-হাঙরের রাজ্যে বারবার পাড়ি জমিয়েছে মানুষ। কখনও পিঠে বেলুন লাগিয়ে ঝাঁপ দিয়েছে আকাশ থেকে, কখনও পিঠে অক্সিজেন ঝুলিয়ে পা রেখেছে কঠিন পর্বতশৃঙ্গে। পৃথিবীর বেশির ভাগ জায়গাতেই নিজের পায়ের ছাপ ফেলেছে মানুষ। তবু বাকি রয়ে গিয়েছে অনেকটাই। আবার বিশ্বে এমনও কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে নিজেদের প্রবেশ নিজেরাই নিষিদ্ধ করেছে মানুষ। কিন্তু কেন? আসলে এই সমস্ত জায়গার বেশিরভাগই প্রাকৃতিক ও বন্য সম্পদে পরিপূর্ণ।
কোনও জায়গায় আবার সংরক্ষিত রয়েছে গোপন নথি। তাই নিজের তাগিদেই মানুষ এই সমস্ত জায়গায় নিজেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। গ্যালারি থেকে দেখে নেওয়া যাক এমনই কিছু জায়গার নাম।

দুনিয়ার সবচেয়ে ছোট মানুষ

By On 9:02:00 PM

জুনরেয় বালাউইং হলেন গিনিজ রেকর্ডধারী পৃথিবীর জীবিত সবচেয়ে খাটো মানুষ!! ২০১১ সালে নেপালের থাপার মাগার(২৬. ইঞ্চি) নামক ব্যাক্তিকে পরাজিত করে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে খাটো মানুষের খেতাব জিতে নেন!! জুনরেয় বালাউইং ১৯৯৩ সালে ফিলিপাইনের সিন্দাঙ্গান নামক অঞ্ছলে জন্মগ্রহন করেন।। উনার বর্তমান উচ্চতা ২৩. ইঞ্চি!!

ব্যাঙের জুস

By On 8:59:00 PM
পেরুতে গত ১৫ বছর ধরে ব্যাঙের জুস বিক্রি করা হচ্ছে।। সেখানকার কিছু স্থানীয়রা প্রতিদিন এই জুস পান করে থাকেন!! কারন, তাদের ধারণা, থেকে তারা শক্তি পায়!!

কারমেন গঞ্জালেস নামের একজন মহিলা সর্বপ্রথম এই জুস তৈরি করা শুরু করেন।। তার দেখাদেখি আরো অনেক জুসের দোকানে ব্যাঙের জুস বিক্রি করা শুরু হয়।। এক একটি দোকানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০ গ্লাস জুস বিক্রি হয়ে থাকে।। শুধু স্থানীয়রাই নয়, ...মনকি পেরুতে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের কাছেও এই জুসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে!!

প্রথমে জ্যান্ত ব্যাঙগুলোকে আগে একটা একুরিয়ামে রাখা হয়।। তারপর সেখান থেকে নিয়ে মেরে সেটার চামড়া ছিলে ব্লেন্ডারে দেয়া হয়।। সাথে থাকে আরো প্রায় ২০টি উপাদান!! যেমনঃ মধু, অ্যালো ভেরা, বিভিন গাছের শিকড়, ইত্যাদি।। আপনার জন্য প্রতি গ্লাস জুসের দাম পড়বে মাত্র ডলার(2$)!! তবে যারা পান করে তাদের ধারণা, মাত্র ডলার এই অসাধারণ জুসটির জন্য আসলেই কম!!

ছবিতে জুস তৈরির ধাপগুলো পর পর দেয়া আছে!!